বিংশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা History WBBSE Madhyamik Class 10
Here you will learn the basics of বিংশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা History WBBSE Madhyamik Class 10 Chapter 5 History Itihas WBBSE Madhyamik in a simple language it is for Bengali medium students who are studying under West Bengal Board of Secondary Education and preparing for their Madhyamik exam (Class 10 WBBSE) Here you will find all necessary and important WBBSE Madhyamik Suggestions class 10, notes, solved sample question paper in Bangla along with video lectures from expert teachers
এখন সহজে পাস্ করুন পরীক্ষা skillyogi'র নোটস, সাজেশন, সল্ভড পেপার এবং ভিডিও লেকচারের মাধ্যমে।
ফর্মে নিজের ফোন নম্বর ভরুন, এবং সহজে সাহায্য পান
ভূমিকা
বিংশ শতকে ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে সকল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সমগ্র বাংলা জুড়ে গড়ে ওঠা স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে একের পর এক অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয় এবং অল্পদিনেই সেগুলি জাতীয় আন্দোলনের রূপ নেয়। এভাবে ধীরে ধীরে জাতীয় আন্দোলনে কংগ্রেসের ভূমিকা প্রকট হতে থাকে।
কিন্তু ১৯২০ এর দশকে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্রিটিশ বিরোধী এই সকল আন্দোলনে বামপন্থীরাও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে থাকে।
ফলস্বরূপ এই সময় ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন গুলিতে কংগ্রেস ও বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলি নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে শ্রমিক-কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে তৎপর হয়ে ওঠে।
বিংশ শতকের কৃষক আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতি
বিংশ শতকেও ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়।
- ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন,
- ১৯২০ সালের অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন,
- ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলন
- ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে
দেশের প্রতিটি স্থানের সর্বস্তরের কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে। এইসকল আন্দোলনে কৃষকদের ওপর নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কংগ্রেস সহ বামপন্থী দলগুলো বিভিন্নভাবে প্রয়াস চালাতে থাকে।
স্বদেশী আন্দোলন-পর্বে কৃষক আন্দোলন :
উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলা ।
- দেশের অন্যান্য প্রান্তে এই জাতীয়তাবাদের প্রসার রোধ করার উদ্দেশ্যে সরকার সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতির আশ্রয় নিয়ে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
- বাংলা ও বাঙালির একতায় ভাঙন ধরানোর উদ্দেশ্যে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড কার্জন রিজলি কমিশনের সুপারিশ অনুসারে বাংলা ভাগ করেন।
- পশ্চিমবাংলার সাথে বিহার ও উড়িষ্যা কে যুক্ত করে গঠিত হয় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল যার রাজধানী কলকাতা,
- অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলার রাজধানী হয় ঢাকা।
- বঙ্গভঙ্গের সরকারি সিদ্ধান্তটি ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলার সর্বত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
- এই আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস সক্রিয় ভুমিকা পালন করে। কংগ্রেসের নরম পন্থী নেতা রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বেঙ্গলি পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গকে ‘গুরুতর জাতীয় বিপর্যয়’ আখ্যা দিয়ে তা রোধ করার ডাক দেন।
- আন্দোলনের দুটি ধারার একটি স্বদেশী ও অন্যটি বয়কট নামে পরিচিত।
- ‘বয়কট’ অর্থে বিলিতি পণ্য সামগ্রীর সাথে সাথে চিন্তাধারা আদর্শকেও বর্জন
- ‘স্বদেশি’ বলতে কেবল দেশি দ্রব্য ই নয়, তার সাথে জাতীয় ভাষা,সাহিত্য,শিক্ষা, রাজনৈতিক আদর্শ কে গ্রহণ।
- স্বদেশী আন্দোলন যেহেতু মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্বারা এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থে পরিচালিত হয়েছিল, তাই কৃষকরা খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করলে দেশীয় জমিদাররা ক্ষুব্ধ হবেন এই আশঙ্কায় কংগ্রেসের নেতারা কৃষকদের এই আন্দোলনে যুক্ত করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে।
- ডঃ বিপানচন্দ্রের মতে এই এই আন্দোলন আশাপ্রদ ভাবে বাংলার কৃষকসমাজ কে স্পর্শ করতে পারেনি। ডঃ সুমিত সরকারের মত অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির অভাবে আন্দোলন থেকে কৃষকরা বিরত থাকে।
- ১৯০৭ সালে লর্ড মিন্টো পাঞ্জাবে এক নতুন আইন চালু করে অতিরিক্ত জলকর চাপানো হয়। লালা লাজপত রায় এবং অজিত সিং এই আইনবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন।
- ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে মেওয়াড়ের বহু চাষী সীতারাম দাসের নেতৃত্বে কর বন্ধের আন্দোলন করে।
- এছাড়াও এই সময়কালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে ১৯১৭ খ্রি বিহারের চম্পারণ জেলায় মতিহারবেতিয়া অঞ্চলে নীলচাষীরা অনিয়ন্ত্রিত নীল চাষ
- ১৯১৮ খ্রি গুজরাটের খেরা জেলার চাষীরা খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলে। গান্ধীজি ও তার অনুগামীরা সক্রিয়ভাবে এই দুই আন্দোলনে যোগ দেন।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলন-পর্বে কৃষক আন্দোলন :
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্তিমলগ্নে জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর ডিসেম্বরে নাগপুর অধিবেশনে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
- এই আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব পান স্বয়ং গান্ধীজি এবং আন্দোলনের মূল অস্ত্র হয় বয়কট। ফলে সারা দেশে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ভিত্তিতে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। গান্ধীজির আহ্বানে লক্ষাধিক কৃষক আন্দোলনে যোগ দেয়।
- কিন্তু ১৯২২ খ্রিস্টব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি উত্তপ্রদেশের গরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা থানায় ২২ জন পুলিশকে পুড়িয়ে হত্যা করলে গান্ধীজি মর্মাহত হয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। তবুও এরপরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষক আন্দোলন চলতে থাকে।
- বাংলা
- বাংলায় মেদিনীপুর,রাজশাহী,বীরভূম,বর্ধমান,জলপাইগুড়ি,দিনাজপুর,বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলার কৃষকরা অসহযোগ বয়কট আন্দোলনকে সমর্থন জানায়।
- বাংলার কৃষক আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।
- তার নেতৃত্বে মেদিনীপুরের তমলুক,কাঁথি মহকুমায় চাষীরা ইউনিয়ন বোর্ড বয়কট করে, চৌকিদারী কর বন্ধ করে দেয়।
- প্রান্তিক, মধ্যবিত্ত, জোতদার সকল শ্রেণীর কৃষক এতে অংশগ্রহণ করে।
- রাজশাহীতে নীলচাষের বিরুদ্ধে সোমেশ্বর প্রসাদ চৌধুরি, বীরভূমে গান্ধীবাদী নেতা জিতেন্দ্রলাল ব্যানার্জি,
- বর্ধমানে দামোদর খাল জলকরের বিরুদ্ধে বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, ঝাড়গ্রামে শৈলজানন্দ সেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
- বিহার
- খাজনা ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিহারের দ্বারভাঙ্গার মহারাজার জমিদারির বিভিন্ন অঞ্চল যেমন দ্বারভাঙ্গা, মজফরপুর, ভাগলপুর,পূর্ণিয়া,মুঙ্গের, সীতামারী, মধুবনি জেলায় কৃষকবিদ্রোহ শুরু হয়।
- স্বামী বিদ্যানন্দ এই আন্দোলনকে পরিচালিত করেন।
- কৃষকরা জমিদারি খাজনা বন্ধ করে দেয় ও পুলিশি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
- দ্বারভাঙ্গা আন্দোলন ছিল মূলত মধ্যবিত্ত চাষীদের আন্দোলন। সেখানকার অধিকাংশ জমিদার কংগ্রেস সমর্থক হওয়ায়, কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে কংগ্রেস জমিদারি অসন্তোষ বাড়াতে চায়নি।
- তাই মধুবনি আন্দোলনের নেতা স্বামী বিদ্যানন্দ কংগ্রেসের থেকে বারংবার সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিছুদিনের মধ্যেই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
- রাজস্থান
- রাজস্থানে কৃষক বিদ্রোহের সূচনা করেন মতিলাল তেজওয়াত।
- তিনি মেওয়ারের বিজোলিয়া অঞ্চলে ভিল জাতির চাষীদের সাহায্যে খাজনা বন্ধ আন্দোলন পরিচালনা করেন।
- অন্যদিকে মাড়োয়ারে জয়নারায়ন ব্যাসের নেতৃত্বাধীন কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়
- যুক্তপ্রদেশ (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ)
- অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন যুক্তপ্রদেশ (উত্তরপ্রদেশ) এ কৃষকদের ওপর শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদে মদনমোহন মালব্য, গৌরিশঙ্কর মিশ্র ও ইন্দ্রানারায়ন ত্রিবেদীর প্রচেষ্টায় ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে যুক্তপ্রদেশ কিসানসভা গড়ে ওঠে।
- এই সভা যুক্তপ্রদেশে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলে যার নেতৃত্বে ছিলেন বাবা রামচন্দ্র।
- প্রতাপগড়, রায়বেরিলি, সুলতানপুর ও ফৈজবাদের কৃষকরা জমিদারের বিরুদ্ধে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
- বাধ্য হয়ে সরকার বিদ্রোহ দমনের জন্য রামচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করে।
- রামচন্দ্রের মুক্তিলাভের পর ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল নেহেরুর প্রভাবে প্রতাপগড়ে ‘অযোধ্যা কিষান সভা’ প্রতিষ্ঠা হয়। ফলে আন্দোলন আরো তীব্রতর রূপ ধারণ করে।
- আন্দোলনের চাপে সরকার ১৯২১ খ্রি ‘অযোধ্যা খাজনা আইন’ পাস করে কৃষকদের কিছু সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে।
- একা আন্দোলন
১৯২১ এর শেষ দিকে উত্তর-পশ্চিম অযোধ্যার বারবাকি, হরদৈ, বারাইচ, সিতাপুর প্রভৃতি অঞ্চলে আবার কৃষক আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে।
আন্দোলন চলাকালে যেকোনো পরিস্থিতিতে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেন–তাই এই আন্দোলন ‘একা’ বা ‘একতা’ আন্দোলন নামে পরিচিত।
কৃষকদের পূর্ব নির্ধারিত করের ওপর বাড়তি ৫০ শতাংশ কর চাপানো, অনাদায়ী করের জন্য কৃষকদের ওপর নির্মম অত্যাচার, বিনা মজুরিতে কৃষকদের বেগার শ্রমে বাধ্য করা প্রভৃতি কারণে অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ রূপে আন্দোলন সংগঠিত হয়।
কংগ্রেস ও খিলাফত নেতারা এই আন্দোলনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে। মাদারী পাসির নেতৃত্বে কৃষকরা আন্দোলনকে শক্তিশালী রূপ দেয়।
আন্দোলনের অপর নেতা বাবা গরিবদাস স্বরাজের দাবি জানান। ক্রমেই একা আন্দোলন হিংস্র হয়ে উঠলে কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেন।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের মধ্যে সরকার চরম দমননীতি প্রয়োগ করে এই আন্দোলনের গতি কমিয়ে দেয়। মাদারী পাসি কারারুদ্ধ হলে আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
- গুজরাট
অসহযোগ আন্দোলনের সমসাময়িক সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কিষান আন্দোলন গুজরাটের সুরাট জেলার অন্তর্গত বারদৌলি তালুকের কৃষক সত্যাগ্রহ আন্দোলন যা ‘বারদৌলি সত্যাগ্রহ’ নামে পরিচিত।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ –
বারদৌলিতে উচ্চবর্ণের মানুষকে বলা হত উজলিপরাজ বা শ্বেতাঙ্গ এবং নিম্নবর্ণের দরিদ্র মানুষদের বলা হত কালিপরাজ বা কৃষ্ণাঙ্গ।
এই তালুকের প্রায় ৬০% মানুষ ছিল কালিপরাজ গোষ্ঠীভুক্ত হরিজন। এরা পেশায় ছিল অধিকাংশ ভূমিহীন ভাগচাষী বা ক্ষেতমজুর।
হালিপ্রথা অনুসারে স্থানীয় উচ্চবর্ণের জমির মালিকদের কাছে বংশানুক্রমিক ভাবে নিম্নবর্গের ভাগচাষীরা কৃষি শ্রমিকের কাজ করত। কালিপরাজ কৃষকরা উজলিপরাজ জনগোষ্ঠীর দ্বারা সীমাহীন শোষণ ও অবজ্ঞার শিকার হত।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় এখানকার স্থানীয় নেতা কল্যানজি মেহেতা ও দয়ালজি দেশাই ৬টি আশ্রম খুলে নানা সমাজ গঠনমূলক কাজ করেন এবং জনসাধারণের মধ্যে সত্যগ্রহের আদর্শ প্রচার করেন।
১৯২৫ এর বন্যায় বারদৌলির চাষীদের ফসল নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সরকার এই তালুকে রাজস্বের হার ৩০% বৃদ্ধি করে। জাতীয় কংগ্রেস এর আপত্তি জানায়, গান্ধীজির ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ ও ‘নবজীবন‘ পত্রিকাতেও সমালোচনা শুরু হয়।
ফলে সরকার সিদ্ধান্ত বদলে ২১.৯৭% হারে রাজস্ব বৃদ্ধি ঘোষণা করে। ফলস্বরূপ বারদৌলির কৃষক ও গ্রাম প্রধানদের অনুরোধে বল্লভভাই প্যাটেল খাজনা বন্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতে নেন।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল কৃষকরা তার নেতৃত্বে অহিংস পথে খাজনা বন্ধ করার যে শপথ নেয় তা ‘বারদৌলি সত্যাগ্রহ’ নামে পরিচিত।
- এই আন্দোলনে নারীরাও সামিল হন।
- প্যাটেল কন্যা মনিবেন প্যাটেল, মিঠুবেন প্যাটেল, ভক্তিবাই, সারদা মেহেতা, সারাদাবেন শাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
- প্যাটেল বারদৌলি তালুককে ১৩ টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলে সত্যাগ্রহ পরিচালনার দায়িত্ব অভিজ্ঞ নেতাদের সমর্পণ করেন।
- এরমধ্যে নরহরি পারিখ, রবিশঙ্কর ব্যাস, মোহনলাল পান্ডে প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
- বল্লভভাই প্যাটেলের সুদক্ষ নেতৃত্বের জন্য সেখানকার মহিলারা তাকে সর্দার অভিধায় ভূষিত করে।
- গান্ধীজি বারদৌলিতে এসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে সংকল্প নেন, সর্দার প্যাটেলের গ্রেফতারের পর গান্ধীজি নিজে আন্দোলন পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দেন। শীঘ্রই এই খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
- আন্দোলনের সমর্থনে বোম্বে আইনসভার সদস্য কে.এম.মুন্সি ও লালজি নারায়ণ পদত্যাগ করেন।
- শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের চাপে সরকার রাজস্ব হার হ্রাস করে ৬.০৩% ধার্য করলে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
- দক্ষিণ ভারত
- ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সুদূর দক্ষিণে কেরালার মালাবার অঞ্চলে মুসলিম মোপলা কৃষকরা মোহাম্মদ হাজীর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। এটি মোপলা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- অল্পদিনেই এই আন্দোলন হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় পরিণত হয়।
- মোপলা নেতা ইয়াকুব হাসান গ্রেপ্তার হলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধ বাড়ে, এরপর ধর্মীয় নেতা আলী মুসলিয়ার এর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মোপলারা সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে ও পুলিশের সাথে খণ্ডযুদ্ধ চলে।
- হিন্দু জমিদারদের ওপর আক্রমণ চলে, প্রায় কয়েকশ হিন্দু নিহত হয় এবং অনেক হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়।
- শেষ পর্যন্ত সরকার সামরিক আইন জারি করে কঠোর হাতে এই বিদ্রোহ দমন করে। কয়েক হাজার মোপলা নিহত হয় এবং গোপাল মেনন, মাধবন নায়ার প্রমুখ নেতারা গ্রেপ্তার হন।
আইন অমান্য আন্দোলন-পর্বে কৃষক আন্দোলন :
- প্রেক্ষাপট
- ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজের দাবি গ্রহণ করে।
- ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে গান্ধীজি ১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ১১দফা দাবি প্রকাশ করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই দাবিগুলো অগ্রাহ্য করলে গান্ধীজি খুবই ক্ষুব্ধ হন।
- এর ফলস্বরূপ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং গান্ধীজির ওপর তা পরিচালনার ভার ন্যাস্ত হয়।
- আইন অমান্য আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মেনে ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ গুজরাটের সমুদ্রাপকূলে অবস্থিত ডান্ডিতে সমুদ্রের জল থেকে লবণ তৈরির মাধ্যমে লবন আইন অমান্য করে এই আন্দোলনের সূচনা করেন।
- বৈশিষ্ট্য
- আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কৃষক বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে।
- উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বাংলা, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, কেরালা প্রভৃতি রাজ্যে আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে।
- উত্তরপ্রদেশের বারবাকি, এলাহাবাদ, রায়বেরিলি, লখনৌ, মিরাট প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষকরা জমিদারি ও সরকারি উভয় খাজনা দেওয়া বন্ধ করে আন্দোলন চালাতে থাকে।
- কংগ্রেস সহ বামপন্থী দলগুলো সরাসরি এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ে। অঞ্জনিকুমার, কালিকাপ্রসাদ, রফি আহমেদ প্রমুখ নেতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
- ক্রমান্বয়ে জওহরলাল নেহেরু ও এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
- বিহারে মন্দার সময়ে খাজনা দিতে অক্ষম চাষীদের কাছ থেকে যে সকল জমিদাররা জমি কেড়ে নেন, সেই জমি পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। কৃষকরা জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ দাবি করে।
- যদুনন্দন শর্মা, পঞ্চানন শর্মা, রাহুল সংকৃত্যায়ন এর মত বামপন্থী নেতারা এই আন্দোলনকে উস্কানি দেন ফলস্বরূপ ক্রুদ্ধ কৃষকরা মুঙ্গেরে ও মজফরপুরে থানা আক্রমণ করে।
- যদুনন্দন শর্মা ও স্বামী সহজানন্দ এর নেতৃত্বে বিহারের গয়া জেলার কিষাণ সভা স্থাপিত হয়।
বাংলার আরামবাগ, ত্রিপুরা, শ্রীহট্টে কৃষকরা খাজনা বন্ধ করে, কাঁথি ও মহিসাদলে ভাগচাষীরা আন্দোলন শুরু করে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ আন্দোলন সমর্থনের বদলে কৃষক-জমিদার বিবাদ মীমাংসা করতে সচেষ্ট হয়, ফলে তারা পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষকদের সর্মথন হারায়। মুসলিম কৃষকরা কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
গুজরাটে খেদা, সুরাট ও বারদৌলিতে কৃষক সত্যাগ্রহ শুরু হয়। সেখানকার রাসগ্রামের পত্তিদার সম্প্রদায়ের কৃষকরা ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত খাজনা বন্ধ আন্দোলন চালিয়ে যায়।
কেরালায় কংগ্রেস নেতা কেল্লাপ্পন কিষান সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালান। অন্ধ্রপ্রদেশে বাল রামকৃষ্ণের নেতৃত্বে কৃষ্ণা জেলায় খাজনা বন্ধ আন্দোলন চলে।
এছাড়াও মাদ্রাজ, মাদুরাই, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানে খাজনা বন্ধের পাশাপাশি মহাজনদের সম্পত্তি লুঠ বাজেয়াপ্তকরণ নানা উপায়ে কৃষক আন্দোলন চালিয়ে যায়।
- আইন অমান্য আন্দোলনের পরেও ভারতে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট দলের প্রচেষ্টায় কিষাণ আন্দোলনের পতাকা উড়তে থাকে। এর আগেই ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোহিয়া, আচার্য নরেন্দ্র দেব প্রমুখ কংগ্রেসে থাকাকালীনই কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্টা করেন।
- ১৯৩৬ খ্রি কংগ্রেসের লখনৌ অধিবেশনে সভাপতি জওহরলাল নেহেরুর সমর্থনে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট দের প্রচেষ্টায় এন.জি. রঙ্গের উদ্যোগে সারা ভারত কিষাণ কংগ্রেস স্থাপিত হয়।
- এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতি হন বিহারের স্বামী সহজানন্দ এবং সম্পাদক হন উত্তরপ্রদেশের এন.জি. রঙ্গ।
- এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোহিয়া, ই.এম.এস.নামব্রুদ্রিপাদ, বঙ্কিম মুখার্জি, মোহন সিং প্রমুখ উল্লেখযোগ্য কিষাণ নেতা।
- এই সভা সারা দেশে প্রচারকার্য চালাতে থাকে। কমিউনিস্ট নেতারা কৃষকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রসারে উদ্যোগী হয়।
- পরবর্তীকালে রাজনৈতিক মতভেদের জন্য কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কিষাণ সভা থেকে সরে গেলে কমিউনিষ্টরাই কিষাণ আন্দোলনের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন-পর্বে কৃষক আন্দোলন :
ব্রিটিশ সরকারের ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি হরিজন পত্রিকায় ব্রিটিশ সরকারকে ভারতের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান। সেই বছরেই ১৪ই জুলাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গৃহীত হয়।
কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ভারত ছাড়ো প্রস্তাব সম্পর্কে অনমনীয় কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে। অবশেষে ৮ই আগস্ট মুম্বাই অধিবেশনে গান্ধীজি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করব অথবা মরব–করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।
আন্দোলন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সরকার ৯ই আগস্ট গান্ধীজি, বল্লভভাই, জওহরলাল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সহ প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতার করে এবং কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নেতৃত্ব ছাড়াই সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনকে গণ আন্দোলনের রূপ দেয়।
- আন্দোলন শুরুর সাথে সাথেই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মাদ্রাজ, অন্ধ্র, গুজরাট, যুক্তপ্রদেশ, কেরালা, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি প্রদেশে মধ্যবিত্ত থেকে প্রান্তিক– সমাজের সর্বস্তরের কৃষকরা, এমনকি ক্ষেতমজুর শ্রেণীও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগদান করে।
- স্টিফেন হেনিংহ্যামের মতে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে কৃষকরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেয়। জমিদার শ্রেণী জাতীয়তাবাদী আবেগ নিয়ে আর নিম্নবর্ণের দরিদ্র কৃষকরা দুরাবস্থা দূরীকরণের আশা নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়।
- বাংলার মেদিনীপুর, হুগলি, বীরভূম, ফরিদপুর প্রভৃতি স্থানের রাজবংশী ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের কৃষকরা ব্যাপকভাবে এই আন্দোলনে যোগদান করে। বাংলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা জমিদারদের খাজনা বন্ধ করে দেয়।
- বিহারের কৃষকরাই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি। বিহারের কিষাণ সভার কর্মীরা আন্দোলনে অংশ নেয়।
- মুঙ্গের, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া, সাঁওতাল পরগনার আদিবাসী কৃষকরা বিহারের থানা দখল করে নেয়।
- উড়িষ্যার কটক, তালচের, বালেশ্বর অঞ্চলে উপজাতি কৃষক অভ্যুত্থান ঘটে।
- আন্দোলনে ইংরেজদের সহায়তাকারী জমিদারদের শস্য লুঠ করে ও কর বন্ধ করে দেওয়া হয়। গুজরাটের খান্দেস, সাতারা, সুরাট, ব্রোচ প্রভৃতি জেলার কৃষকরা গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালায়।
- সুরাটের কৃষকরা রেল অবরোধ করে রেল যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়, সরকারি নথি পুড়িয়ে দেয়।
- যদিও কমিউনিস্ট পার্টি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে তবুও হিতেশরঞ্জন সান্যালের তথ্য থেকে জানা যায় যে মেদিনীপুর জেলার কৃষক সভার বহু সদস্য পার্টির নির্দেশ অমান্য করে আন্দোলনে যোগ দেয়।
বিংশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতি
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ভারতে আধুনিক শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠে প্রধানত ইউরোপীয় প্রচেষ্টায়। এই সময়েই ব্রিটিশ পুঁজিতে গড়ে ওঠা বাগিচা শিল্প ও কয়েকটি কারখানায় ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়।
পরিশ্রম ও মজুরির অসামঞ্জস্যতা, আর্থিক দুরাবস্থা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, শিক্ষা চিকিৎসার অভাব প্রভৃতির ফলে তাদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। বিংশ শতকের প্রথমদিকে শ্রমিক শ্রেণী জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায় আন্দোলনে যুক্ত হয় কিন্তু পরবর্তীতে সমাজে বামপন্থী চিন্তাধারার প্রভাব বাড়তে থাকে।
এইসময় বামপন্থীরাও শ্রমিকদের সংগঠিত করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে অগ্রসর হয়। স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রসারে শ্রমিক আন্দোলন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
Chittaranjan Das
স্বদেশী আন্দোলন-পর্বে শ্রমিক আন্দোলন :
- ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন অংশে রেলওয়ে ওয়ার্কশপে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়।
- এই সময় বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাস, লিয়াকত হোসেন প্রমুখ কংগ্রেস নেতা শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন।
- এইসময় শ্রমিকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন অম্বিকাচরণ ব্যানার্জি।
- প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী, অস্বিনীকুমার ব্যানার্জি, অপূর্বকুমার কঘোষ সহ শ্রমিকনেতাদের উদ্যোগে বিভিন্ন কল কারখানায় ধর্মঘট পালিত হয়।
- বঙ্গভঙ্গের দিন শ্রমিকরা প্রতিবাদ মিছিলে যোগদান করে এবং ঐক্যের প্রতীক হিসেবে একে অন্যের হাতে রাখি বেঁধে দেয়।
- ধীরে ধীরে সকল সরকারি কারখানা, ছাপাখানা, রেল, ট্রাম, চটকল প্রভৃতি সংস্থায় শ্রমিক আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে।
- হাওড়ার বার্ন কোম্পানি থেকে বাউরিয়া জুটমিল, কলকাতা ট্রাম কোম্পানি থেকে জামালপুরের রেল ওয়ার্কশপ সর্বত্র শ্রমিক ধর্মঘট ঘটে।
- তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে বস্ত্র কারখানা, পাঞ্জাব ও বোম্বের অস্ত্র কারখানতেও ধর্মঘট পালিত হয়।
- বালগঙ্গাধর তিলকের কারাদণ্ডের প্রতিবাদে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ের বস্ত্রশিল্প শ্রমিকরা ছয়দিন ধর্মঘট পালন করে।
- ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমনের জন্য শ্রমিকদের ওপরে অত্যাচার চালায়। এরপর স্বদেশী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লে শ্রমিক আন্দোলনও দমে যায়।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলন-পর্বে শ্রমিক আন্দোলন :
- ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে বলসেভিক বিপ্লব ভারতীয় শ্রমিকদের মনে আশা জুগিয়েছিল। ১৯১৭ এর পর থেকেই ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন গুলিতে কমিউনিস্ট প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
- মহাত্মা গান্ধীও আহমেদাবাদে বস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে সত্যাগ্রহ করেন।
- ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন কুখ্যাত আইন ও কার্যকলাপের প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ধর্মঘট ও বিক্ষোভ দেখায়।
- এরপর ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে শ্রমিক আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ নেয়।
- অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সারা ভারতের বিভিন্ন শিল্প কারখানা, রেলওয়ে, ট্রাম, খনি, চা বাগান এর শ্রমিক ও কুলিরা আন্দোলনে যোগ দেন।
- কলকাতা, বোম্বে, খড়গপুর, সোলাপুর, কানপুর প্রভৃতি স্থানের রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কর্মীরা ধর্মঘট করে।
- বাংলায় রেল ও স্টিমার পরিবহন আন্দোলন হয়।
- রানীগঞ্জ ও ঝরিয়া কয়লাখনি অঞ্চল ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন স্বামী বিশ্বানন্দ ও স্বামী দর্শনানন্দ।
- আসামের চা বাগান শ্রমিক সংগঠনে মুখ্য ভূমিকা নেন গান্ধী মহারাজ। সেখানকার প্রায় ১২হাজার চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক ধর্মঘট চালায়।
- চা বাগান ত্যাগ করে তারা বাড়ি ফিরতে উদ্যোগী হলে স্টিমার ঘাটে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়, প্রতিবাদে চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেল ও পদ্মার বিভিন্ন স্টিমার ঘাটে শ্রমিক ধর্মঘট হয়।
- প্রিন্স অফ ওয়েলস এর ভারত ভ্রমণের বিরোধিতায় বোম্বাই শহরের এক লাখ সুতাকল কর্মী ধর্মঘট পালন করে।
- ১৯২২ এ গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে কিছুদিনের জন্য শ্রমিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট দের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ১লা মে মাদ্রাজের বিখ্যাত নেতা সিঙ্গারাভেলু চেটিয়ার সমুদ্রতীরে শ্রমিকদের নিয়ে ভারতের প্রথম মে দিবস পালন করে। এরপর শ্রমিক আন্দোলন আবার দিশা দেখতে শুরু করে।
বিভিন্ন কংগ্রেস ও বামপন্থী নেতা– বি.পি.ওয়াদিয়া, এন.এম.জোশি, জোসেফ ব্যাপ্তিস্ত, তিলক, লালা লাজপত রায় প্রমুখের উদ্যোগে শ্রমিকদের নিয়ে ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস‘ (AITUC) গঠিত হয়। সভাপতি হন লালা লাজপত রায়।
বাম পন্থী চিন্তা ধারার প্রকাশ
- সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু কংগ্রেসে যোগদান করার পরেই কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী চিন্তাধারার প্রসার ঘটে।
- নিচুতলার শ্রমিক ও কৃষকরা এই ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়। শ্রমিক ও কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ১ নভেম্বর বাংলায় কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে ‘লেবার স্বরাজ পার্টি অফ দা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে একটি দল প্রতিষ্ঠা হয়।
- এর প্রতিষ্ঠাতা দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্ত কুমার সরকার, কুতুবউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
- ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে নদিয়ার কৃষ্ণনগরে নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলনে এই দলের নতুন নামকরণ হয় ‘ ওয়ার্কার্স এন্ড পেসেন্টস পার্টি অফ বেঙ্গল‘ (শ্রমিক ও কৃষক পার্টি) ।
- প্রথম সভাপতি হন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত এবং যুগ্ম সম্পাদক হন হেমন্তকুমার সরকার ও কুতুবউদ্দিন আহমেদ।
- অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলা ছাড়া বোম্বাই, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ প্রভৃতি জায়গায় শাখা গড়ে ওঠে।
- এই দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল –
- শ্রমিকদের কাজের সময় হ্রাস,
- সর্বনিম্ন মজুরির হার,
- শ্রমিকদের সংগঠিত করা,
- জমিদারি প্রথার বিলোপ,
- সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা।
- ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন প্রদেশের শাখাগুলো একত্রিত হয়ে ‘সারা ভারত ওয়ার্কার্স এন্ড পেসেন্টস পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- সাধারণ সম্পাদক হন আর.এস.নিম্বকার।
- বিভিন্ন প্রদেশে এই দলের পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে যাতে নেতারা শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবির পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এইসব পত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল–
পত্রিকার নাম | সম্পাদক |
সোস্যালিস্ট | এস.এ.ডানগে |
লেবার কিষান গেজেট | এস.চেটটিয়ার |
ইনকিলাব | গোলাম হোসেন |
লাঙ্গল | নজরুল ইসলাম |
- ‘যুব কমরেড লিগ’ নামে পেজেন্টস পার্টির যুব শাখা গড়ে ওঠে পি. সি. জোশির নেতৃত্বে।
- বোম্বাইয়ে বস্ত্রশিল্পে শ্রমিক ছাঁটাই কে কেন্দ্র করে দেড় লক্ষ শ্রমিক ছয় মাস ব্যাপী স্মরণীয় ধর্মঘটে সামিল হন।
- বাংলার চেঙ্গাইলে ও বাউরিয়াতেও জুটমিলে ছয় মাস ব্যাপী ধর্মঘট চলে।
- সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধেও বোম্বাই ও কলকাতার শ্রমিকরা সোচ্চার হয়।
- শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতায় শঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকার শ্রমিক উন্নতিতে হুইটলি কমিশন গঠন করে। বরোলাট লর্ড আরউইন শিল্প বিরোধ বিল পাস করিয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘট বেআইনি ঘোষণা করেন।
- দলের নেতাদের দমনের জন্য ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। ফলে শ্রমিক আন্দোলন আবার দুর্বল হয়ে পড়ে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ-পর্বে শ্রমিক আন্দোলন :
- ১৯৪৫-৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে আবার শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার আসে, দিল্লির লালকেল্লায় বন্দি আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের বিচারের প্রতিবাদে শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
- কলকাতায় রশিদ আলী দিবস পালিত হয়। ১৯৪৫ এর শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বোম্বাই ও কলকাতা বন্দরে শ্রমিকরা ইন্দোনেশিয়া গামী জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করতে অস্বীকার করে।
- ১৯৪৬ এ নৌ বিদ্রোহ শুরু হলে বোম্বাই এ নৌ সেনাদের বিদ্রোহ সমর্থন করে তিন লক্ষ শ্রমিক ধর্মঘট করে।
- বোম্বাইয়ের রাস্তায় সেনা পুলিশদের সাথে শ্রমিকদের খণ্ডযুদ্ধ বাধে, ২৫০ শ্রমিক নিহত হয়। সারা ভারত ডাক ও তার কর্মীরা ধর্মঘট পালন করে।
১৯০৫ এর স্বদেশী আন্দোলনের সময় ভারতে বামপন্থী ভাবধারা প্রসারলাভ করেনি। তাই এই সময়ে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন বিশেষ গতি পায়নি। কৃষক আন্দোলন কিছুক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করেছিল।
১৯২০ এ বামপন্থার উন্মেষ ঘটলে পরবর্তী আন্দোলনগুলিতে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ বামপন্থী চিন্তাধারা সমাজের কৃষক ও শ্রমিকবর্গের মনে যথেষ্ট ছাপ ফেলতে শুরু করে। তবে শ্রমিক আন্দোলন মূলত বাংলা ও বোম্বেতে প্রভাব ফেললেও দেশের অন্যস্থানে তেমন প্রভাব দেখা যায় না।
কৃষক আন্দোলনও কিছু জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকদের যুক্ত করার জন্য কোনো প্রচেষ্টাই করেনি। তাই ধীরে ধীরে বামপন্থী নেতারা জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
বিংশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতি
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে এম.এন.রায়ের নেতৃত্বে রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সাথে সাথে ভারতীয় রাজনীতিতে বামপন্থী ধারার প্রচলন শুরু হয়। কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও বামপন্থী চিন্তাধারার প্রসার ঘটে। ভারতেও বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সূচনা হয়।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দ থেকেই ব্রিটিশ সরকার সন্দেহের বশে কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে। এই মামলা পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও বামপন্থী অগ্রগতি আটকানো সম্ভব হয়নি।
মানবেন্দ্রনাথ রায় ও ভারতের বামপন্থী আন্দোলন :
- রাশিয়ায় উদ্ভূত বামপন্থী ভাবধারা এদেশে প্রসারে যারা বিশেষ ভূমিকা পালন করে তাদের মধ্যে অন্যতম বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় (আসল নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)
- তিনি গুপ্ত বিপ্লবী কার্যকলাপে যোগ দিয়ে মি.মার্টিন, মানবেন্দ্রনাথ, হরি সিং, ডঃ মাহমুদ, মি.ব্যানার্জি প্রভৃতি ছদ্মনাম নেন।
- বিপ্লবী অভিযোগে তিনি ‘হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা’ য় অভিযুক্ত হন।
- বার্লিনে ‘ভারতীয় বিপ্লবী কমিটি’ গড়ে তোলেন।
- অবনী মুখার্জি, মুহম্মদ আলী, মুহম্মদ সাফিক এদের সহযোগিতায় রাশিয়ার তাসখন্দে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ (১৭ অক্টোবর, ১৯২০) প্রতিষ্ঠা।
- মস্কোতে শ্রমিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
- বার্লিন থেকে ‘ভ্যানগার্ড অব ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স’ নামক পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ।
- ১৯৩০ এ ব্রিটিশ সরকারের হাতে ডঃ মাহমুদ নাম নিয়ে গ্রেফতার হন।
- ১৯৩৭ এ কংগ্রেসের মধ্যে ‘লীগ অব রেডিক্যাল কংগ্রেসমেন’ প্রতিষ্ঠা। লক্ষ্য কংগ্রেসের ভেতর বামপন্থী ভাবধারার প্রসার।
- ১৯৪০ এ কংগ্রেস ত্যাগ করে ‘রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’ গঠন।
- তার লেখা উল্লেখযোগ্য বই – ‘ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন’, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন’, ‘ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা’, ‘বিজ্ঞান ও কুসংস্কার’, ‘নব মানবতাবাদ : একটি ইস্তেহার’ ইত্যাদি।
বামপন্থী আন্দোলনের চরিত্র :
- ভারতের বাইরে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হবার পর ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুরে বিভিন্ন স্থানের বামপন্থী নেতারা মিলিত হয়ে ভারতের মাটিতে প্রথম ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেন।
- কিন্তু বামপন্থী ভাবধারা রোধে ব্রিটিশ সরকার প্রথম থেকেই সক্রিয় ভূমিকা নেয়। তারা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, বিভিন্ন বামপন্থী নেতাদের ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’ ‘কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা’ ইত্যাদি মামলায় অভিযুক্ত করে আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়।
- কারণ বামপন্থী দলগুলি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। তাই বামপন্থী নেতারা গোপনে বাংলা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বামপন্থী ভাবধারার প্রচার চালায়।
- এমনকি কংগ্রেসের ভিতরেও বামপন্থী মনোভাব সম্পন্ন কিছু নেতা কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গঠন করে এই ভাবধারা বজায় রাখার চেষ্টা করেন।
- তাঁদের উদ্যোগে
- ‘রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’,
- ‘নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস‘ (AITUC), ‘
- ভারতের জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন’ (INTUF), ‘
- নিখিল ভারত রেলওয়ে মেনস ফেডারেশন’ (AIRMF) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- বামপন্থী নেতারা ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সাথে সাধারণ কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থের দিকেও বিশেষ দৃষ্টি দেন। ফলে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেও বামপন্থী প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এরাই বামপন্থী আন্দোলনের মূল হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
- তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বামপন্থী দলগুলির সরকারকে সাহায্যের নীতি, ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়া বা দেশভাগের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বামপন্থী দলগুলির পদক্ষেপ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বামপন্থী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :
- ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে যাতে ৩৩ জন শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
- ভারতীয়দের মধ্যে মুজাফফর আহমেদ, মিরাজকর, পি.সি.জোশি, এস.এ.ডাঙ্গে, গঙ্গাধর অধিকারী, ধরণী গোস্বামী, শিবনাথ ব্যানার্জি প্রমুখ এবং ৬ জন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট নেতা বেঞ্জামিন ব্যাডলি, ফিলিপ স্প্ৰাট প্রমুখ গ্রেফতার হন।
- ৮ জন কংগ্রেস নেতাও এতে সামিল ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। বাকি নেতারা কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে কর্মসূচি চালাতে থাকে।
- ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের মধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠা হয় ‘কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি‘ (কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল)।
- দলের প্রধান লক্ষ্য হয় কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে শক্তিশালী করা।
- কংগ্রেসের বামপন্থী অংশ, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও বামপন্থীরা একত্রে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ‘সারা ভারত কিষাণ কংগ্রেস‘ প্রতিষ্ঠা করে।
- এই সকল দলগুলির লক্ষ্য ছিল
- ভারতের পূর্ন স্বাধীনতা,
- বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ,
- জমিদারিপ্রথা বিলোপ,
- কৃষি, ভূমি,
- শিল্প সংস্কার,
- কৃষিঋণ মকুব,
- খাজনা হ্রাস প্রভৃতি।
- কংগ্রেসের তরুণ নেতারাও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীকে যুক্ত করার প্রয়াস করেন।
- জওহরলাল নেহেরু ও সুভাষচন্দ্র বসু তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। জওহরলাল নেহেরু লাহোর কংগ্রেসের অধিবেশনে নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলে দাবি করে বলেন ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম একসাথে চলতে পারে।
- সুভাষচন্দ্র বসুও মনে করতেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ই এদেশে দারিদ্রের মূল কারণ। কংগ্রেসের ডানপন্থী নেতারা নেহেরু ও সুভাষের এই বামপন্থী মনোভাব পছন্দ করেননি।
- তাই নেহেরু গান্ধীজির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে কংগ্রেসে জায়গা পেলেও, সুভাষ দল থেকে বহিষ্কৃত হয়। সুভাষ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ফরওয়ার্ড ব্লক কে পৃথক দল হিসেবে গড়ে তোলে।
- এছাড়াও কয়েকজন ভারতীয় বিপ্লবী ১৯৪০ এই রামগড়ে ‘বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল’ (RSP) প্রতিষ্ঠা করে।
- বাংলায় ‘কৃষক প্রজা পার্টি’, যুক্তপ্রদেশে ‘জাতীয় কৃষক পার্টি’, পাঞ্জাবে ‘ইউনিয়নিস্ট পার্টি’, মাদ্রাজে ‘জাস্টিস পার্টি’ বামপন্থা প্রসারের দৃষ্টান্ত। এই সকল দলই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে।
ফলে কৃষক আন্দোলনও জাতীয় আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠে। ১৯৩৭ এ সরকার তেভাগা প্রস্তাব না মানলে বামপন্থী পরিচালিত ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণ সভা’ ‘তেভাগা আন্দোলন’ শুরু করে।
বামপন্থী আন্দোলনের পর্যালোচনা :
কৃষক শ্রমিক আন্দোলন কে একত্রিত করার ক্ষেত্রে বামপন্থী দলগুলি সাফল্য পেলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকারকে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ এবং কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করায় সমালোচনার মুখে পড়ে। তারা স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রভাব ফেললেও কোনোদিনই কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি।
ভারতীয় কমিউনিস্টদের আন্দোলনের প্রেরণা, কর্মসূচি সবই এসেছিল বিদেশ থেকে। কংগ্রেসের মতো ভারতীয় অনুপ্রেরণা তাদের ছিলনা।
বামপন্থী অধিকাংশ আন্দোলন শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, গ্রামের নিম্ন স্তরের অশিক্ষিত, দরিদ্র সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আন্দোলনের বিশেষ প্রভাব পড়েনি।
বিংশ শতকের ভারতে বিভিন্ন কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন
বোম্বাইয়ে শ্রমিক ধর্মঘট | ১৯০৮ |
যুক্তপ্রদেশ কিষাণ সভা | ১৯১৮ |
নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস | ১৯২০ |
কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা | ১৯২০ |
বাংলায় শ্রমিক ধর্মঘট | ১৯২০-২১ |
যুক্তপ্রদেশ একা আন্দোলন | ১৯২১-২২ |
কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা | ১৯২৪ |
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা | ১৯২৫ |
লেবার স্বরাজ পার্টি অব দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস | ১৯২৫ |
বোম্বাইয়ে বস্ত্রশিল্পে ধর্মঘট | ১৯২৮ |
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা | ১৯২৯ |
কৃষকদের খাজনা বন্ধ | ১৯৩০-৩২ |
রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা | ১৯৩১ |
কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠা | ১৯৩৪ |
সারা ভারত কিষাণ কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা | ১৯৩৬ |
সর্বভারতীয় কিষাণ সভা প্রতিষ্ঠা | ১৯৩৬ |
লীগ অব রাডিক্যাল কংগ্রেসমেন প্রতিষ্ঠা | ১৯৩৭ |
অন্ধ্র উপকূলে কৃষক পদযাত্রা | ১৯৩৮ |
ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা | ১৯৩৯ |
বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠা | ১৯৪০ |